বায়ুদূষণে বাড়ছে কম ওজনের শিশুর জন্ম

কে এম ওবায়দুল্লাহ
প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২২, ০৯:২৯

প্রতীকী ছবি
সারাদেশ নয়, খোদ ঢাকাই এখন অস্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যাসচেম্বার! সর্বকালীন রেকর্ড গড়ে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষস্থানে বাংলাদেশ। দূষণের ভয়াবহ পরিণামের কথা ভেবে সচেতন মানুষ আতঙ্কিত। কী উপায়ে এ সমস্যার মোকাবেলা সম্ভব, তা নিয়ে ভাবনা ও পরিকল্পনার শেষ নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক রিপোর্টে উঠে এসেছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৯৮ শতাংশের ওপরই পড়ছে বায়ুদূষণের প্রকোপ। প্রতি ১০ শিশু মৃত্যুর জন্যও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এটি দায়ী। শুধু তাই নয়, এই বিষ-বায়ু কমিয়ে দিচ্ছে গর্ভের সন্তানের ওজন।
বাংলাদেশের পাশাপাশি আয়ের নিরিখে ‘নিম্ন-মধ্যবিত্ত’ বাকি দেশগুলোতেও একই দৃশ্য। বায়ুদূষণ যেমন রাস্তাঘাটে, তেমনই ঘরের ভেতরেও এর প্রভাব। ডব্লিউএইচওর সমীক্ষা বলছে, শিশুদের শ্বাসকষ্টের পেছনে ৫০ ভাগ দায়ী রান্নাঘরের ধোঁয়া। কারণ এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ ও ডব্লিউএইচওর সোজাসাপটা জবাব হলো, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শহর দিয়ে গ্রাম ঘেরার নির্বোধ বিলাস যেন এসব ঘটনা।
বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি। এর কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশেই ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ জন প্রাণ হারায়। বায়ুদূষণে প্রতিনিয়তই বাড়ছে হাঁপানি, ক্যানসার, হৃদরোগ, সিওপিডিসহ ফুসফুসের বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ। কমছে গড় আয়ু। গত ২২ মার্চ প্রকাশিত ‘বিশ্বের বায়ুর মান প্রতিবেদন-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের ১১৭টি দেশ-অঞ্চলের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’ এটি তৈরি করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যুর প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। ওই বছর মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ ছিল। আর বিশ্বের ৫০টির মধ্যে সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ৪৬টিই এ অঞ্চলের। মূলত বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা (পিএম) ২.৫ মাইক্রোন বা তার চেয়ে ছোট বস্তুকণার পরিমাণ দেখে তালিকা প্রণয়ন করা হয়। একটি চুলের সাথে তুলনা করলে এসব ধূলিকণার আকার চুলের প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগের সমান, যা সহজেই মানবদেহে প্রবেশ করে নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আঘাত করতে পারে।
গবেষকরা জানান, প্রতিদিন প্রশ্বাসের সাথে দূষিত বাতাস দেহের প্রবেশ করায় কিশোরীরা ভুগেছে অনিয়মিত ঋতুচক্রের সমস্যায়। ধীরে ধীরে তা খারাপ প্রভাব ফেলছে প্রজননতন্ত্রের ওপরও। উদ্বেগ বহু গুণ বাড়িয়ে গবেষণা বলছে, মাতৃগর্ভে থাকা শিশুদের ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলছে বায়ুদূষণ। সময়ের আগেই কম ওজনের শিশুদের জন্মের হার বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশুমৃত্যু।
গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে, একজন গর্ভবতী মা যদি প্রতি ঘনমিটার বায়ুর সাথে ৫ মাইক্রোগ্রাম বেশি ধুলোবালি, যানবাহন কিংবা শিল্পকারখানার ধোঁয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করেন, তবে তাদের কম ওজনের সন্তান জন্ম দেওয়ার হার ১৮ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া ওই শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঠিকভাবে হয় না কিংবা মাথার আকৃতি স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট হয়। আর চিকিৎসকরা বলছেন, যেসব শিশুর ওজন জন্মের পর সাড়ে পাঁচ পাউন্ডের কম হয়, তারা শৈশবে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা ও পরবর্তী জীবনে নানান রোগে ভোগে।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে গর্ভবতী মায়েরা অক্সিজেন কম পান, ফলে জন্ম নিচ্ছে প্রিম্যাচিউর ও কম ওজনের পুষ্টিহীন শিশু। বাড়ছে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি। ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং বাড়ছে হাঁপানির প্রবণতা, কানের ইনফেকশনসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি। কিছু কিছু বায়ুদূষণ ফুসফুস ক্যান্সার পর্যন্ত ঘটে থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ঘরের বায়ুদূষণ নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। রান্নার সময় শিশুরা মায়ের সাথে রান্নাঘরে থাকে। গ্যাসের চুলার দূষণে শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।’
তারা আরো বলেন, ‘বায়ুদূষণের পরিমাণ যখন বেশি থাকে, তখন শিশু হাসপাতালে নিউমোনিয়া ও সিওপিডি রোগী অস্বাভাবিক হারে বাড়ে। এসময় মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসকষ্ট চরম অবস্থায় পৌঁছে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও নিজেদের জন্য মুক্ত বাতাস অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য সরকারের উচিত বড় ধরনের স্থাপনার কাজগুলো দিনেরবেলায় না করে রাতে করা। এতে অপেক্ষাকৃত কম দূষণের শিকার হবে মানুষ।’
আইকিউএয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে বস্তুকণার আকার পিএম ২.৫-এর আটত্রিশ গুণ বড় বা প্রায় ৭৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ডব্লিউএইচওর নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটারে যা থাকার কথা ১০ শতাংশেরও কম। সেই হিসাবে দেশের ৯৮ ভাগ মানুষই বায়ুদূষণের নিরিখে সহনশীল মাত্রার অনেক ওপরে বাস করতে বাধ্য হন।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দেশে আজ একজনও অধূমপায়ী নেই! কারণ মাত্রাতিরিক্ত পিএম ২.৫ দূষণের কারণে ধূমপান না করেও, নিজেদের অজান্তে সবাই প্রতিদিন ৫-৭টি সিগারেট সেবনের সমান ক্ষতি করে চলেছেন। সারাদিনে সুস্থ মানুষ ২৫ হাজার বার শ্বাস-প্রশ্বাস নেন, তার জন্য প্রয়োজন হয় ১০ হাজার লিটার বায়ু। একটি সিগারেট ২২ মাইক্রোগ্রাম বা ঘনমিটার পিএম ২.৫-এর বিষক্রিয়ার সমান। অথচ এই দূষণের মাত্র এক মাইক্রোগ্রাম কমাতে পারলেই বছরে বাঁচানো সম্ভব অসংখ্য অমূল্য প্রাণ।
বায়ুদূষণ রোধে ২০১৯ সালে সরকার নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ প্রণয়ন করে। সেখানে বলা হয়েছে, আইনের বিভিন্ন ধারায় উল্লিখত নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে বা লঙ্ঘন করলে, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অর্থদণ্ড এবং কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে; কিন্তু দেশে এই আইনের অধীনে কাউকে দণ্ডিত করার নজির নেই।